
অনলাইন ডেস্ক: বর্তমানে সড়কে চলাচলের প্রধান যান এখন অটোরিকশা। দ্রুত সময়ে সাশ্রয়ী খরচে পরিবহন ব্যবস্থার চাহিদা মেটাতে ব্যাটারিচালিত এই অটোরিকশা ছাড়া পথচলা যেন দায়। আর এ সুযোগে সারা দেশের ন্যায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের শহর, নগর থেকে গ্রামগঞ্জে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এই অটোরিকশা।
জানা গেছে, সরকারিভাবে অবৈধ হিসেবে এই যানটি কাগজে লিপিবদ্ধ থাকলেও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমেই ভারতসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশ থেকে করা হচ্ছে আমদানি। ফলে ডিলারের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে বাজারে। এ কারণে সাধারণ জনগণের কাছে এটি বর্তমানে বৈধ যান হিসেবেই পরিচিত। ফলে জনচাহিদা এবং শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবিকার মাধ্যমে হিসাবে প্রশাসন থেকে দেওয়া হচ্ছে অনুমোদন।
তিনি আরও বলেন, অটোরিকশা এখন সড়কের বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অটোরিকশার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু এই যানটি নিয়ে জনসাধারণের চাহিদা রয়েছে, এ কারণে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও গত এক বছরে কোনো অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সেই সঙ্গে অবৈধ অটোরিকশা ধরতে নিয়মিত অভিযান চলমান আছে। বর্তমানে ডাম্পিং স্টেশন না থাকার কারণে প্রায় ২০০ অটোরিকশার ব্যাটারি জব্দ আছে। এতে পুলিশের আরও বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন। তাছাড়া অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে।
জেলার পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শক আবু নাসের মো. জহিরও এই বিষয়টি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, সাধ্য মতো নিয়মিত মামলা ও জব্দকরণের মাধ্যমে অবৈধ অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে পুলিশের একার পক্ষে অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এম.এম মোহাইমেনুর রশিদ। তিনি বলেন, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে পুলিশ একাই লড়ে যাচ্ছে। অথচ প্রশাসনে আরও অনেক বিভাগ আছে। জেল-জরিমানা করে অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
ময়মনসিংহ জেলা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মোহাম্মদ আবু নাঈম বলেন, প্রায় ৫ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত চলছে অভিযান।
একই চিত্র ময়মনসিংহ বিভাগের অধিকাংশ জেলার।
নেত্রকোণা
রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা, কিংবা বেপরোয়া গতির কারণে ডিগবাজি দিয়ে পাশের ডোবা কিংবা পুকুরে পড়ে যাওয়া অটোরিকশার নিত্য ঘটনা। যানজটে পড়া অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনেও রাস্তা বন্ধ করে অটো চালক ভাড়া নিচ্ছেন যাত্রী থেকে। এমন চিত্র মহল্লার অলিগলি থেকে হাইওয়ে সড়কেও।
নেত্রকোণা পৌরসভার লাইসেন্স শাখার তথ্য অনুযায়ী, শহরে নিবন্ধনকৃত মোট অটোরিকশার সংখ্যা ৫ হাজার ৬১৪টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৫০টি অটোরিকশা, ১ হাজার ৩১১টি মিশুক অটো এবং ১৯০৩টি ছোট রিকশা রয়েছে। পৌরসভার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন শহরে ৩ হাজার ৭৮৩টি ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল করে লাইসেন্সধারী। যা চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
তবে নেত্রকোণা ব্যাটারিচালিত অটোরকিশা মালিক-শ্রমিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. রাসেল মিয়া বলছেন, পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও প্রচুর অটোরিকশা প্রতিদিন শহরে প্রবেশ করে, যা বেআইনি। এটি যানজটের অন্যতম কারণ। এটি বন্ধ করলেই যানজট ও দুর্ঘটনা কমে যাবে।
তবে উল্টো কথা বলছেন আসলাম মিয়া নামে এক অটোরিকশা যাত্রী। তিনি বলেন, অটোরিকশাগুলো ইচ্ছামতো চলাচল করে, নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। কার আগে কে যাবে- এই প্রতিযোগিতা সর্বত্র। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ।
বেপোরোয়া গতি ও অদক্ষ চালকের কারণে অটোরিকশা দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়ে নেত্রকোণা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মাজহারুল আমিন বলেন, নিয়মিতই সড়ক দুর্ঘটনার রোগী হাসপাতালে আসে। এর মধ্যে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত অটোরিকশা।
নেত্রকোণা পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা নুর মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজটের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কোনো অটোরিকশার নতুন লাইসেন্স দিচ্ছি না। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু চাহিদা ও জীবিকার কারণে কঠোর পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে ব্যাটারিচালিত এসব যানের মূল চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ। এগুলো চার্জ করতে গড়ে উঠেছে শত শত রিচার্জ গ্যারেজ। এতে বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগ বেশি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জামালপুর
জামালপুর পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শহরে নিবন্ধিত ব্যাটরিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ হাজার ৩০০টি ও মিশুকের (অটোর ছোট) সংখ্যা ৩ হাজার ১০০টিসহ মোট ৭ হাজার ৪০০টি। প্রতি বছর এসব অটোর জন্য লাইসেন্স বাবদ পৌরসভাকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা ও ছোট অটোর জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। যদিও শহরে প্রতিদিন এর থেকে প্রায় তিনগুণ অটো চলাফেরা করে। এসব অটোর কারণে প্রতিদিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত এক বছরে অর্থ্যাৎ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ৬১টি। এতে আহত হয়েছেন ২ শতাধিক।
বৈধ এবং অবৈধভাবে অটোরিকশা চার্জের কারণে চাপ বাড়ছে বলে স্বীকার করেছেন জামালপুর পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অধিক পরিমাণে অটো থাকায় বিদ্যুতের ওপর চাপ বাড়ছে। অনেকে বাসাবাড়ির মিটার থেকে গোপনে অটো চার্জ দিচ্ছে। এসবের কারণে জেলায় বিদ্যুতের ঘাটতি পড়ছে।
জামালপুর শহরের অটো বিক্রেতা ব্যাঙ মিয়া ট্রেডার্সের কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় অটোর দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ৮ সিটের একটি ভালো মানের অটো বিক্রি হতো ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে বর্তমানে অটো বিক্রি হচ্ছে ২ লাখ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর ৫ সিটের মিশু অটো আগে বিক্রি হতো ১ লাখ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়, এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়।
শেরপুর
শেরপুর জেলার সর্বত্রই দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা। জেলার সড়কগুলোতে বাড়ছে যানজট, দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু। এসব অটোরিকশা চালকদের নেই প্রশিক্ষণ, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা।
শেরপুর পৌরসভার তথ্য মতে, প্রতি বছর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমোদনে পৌর এলাকায় ২ হাজার ৯০০ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়ার কথা। এর মধ্যে চিকন চাকার রিকশা ৫০টি, মোটা চাকার রিকশা ১ হাজার ৩৫০টি এবং ৮ সিটের অটোরিকশা ১ হাজার ৪০০টি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই হারে লাইসেন্স দেওয়া হয়। আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ইতোমধ্যেই ২ হাজার ৪০০টির বেশি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পৌর এলাকার ৪টি ইউনিয়নে আগে ১০০ অটোরিকশার অনুমতি থাকলেও এখন তা বেড়ে ১৪০ হয়েছে। এসব ইউনিয়নের লাইসেন্সধারী অটোরিকশার বড় অংশও পৌর শহরেই চলাচল করছে।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শেরপুর পৌর শহরে অনুমোদিত অটোরিকশার সংখ্যা ২ হাজার ৯০০ হলেও বর্তমানে ৫ থেকে ৬ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি অবৈধ অটোরিকেশা চলছে । ফলে ২৬.৭৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এই পৌর শহরের সড়কগুলোতে জটের সৃষ্টি হচ্ছে।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪ জন। আহত হয়েছেন এর কয়েকগুণ বেশি মানুষ। অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তবে এর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
সূত্র জানায়, শেরপুর জেলার আয়তন ১ হাজার ৩৬৩.৭৬ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১৫ লক্ষাধিক। ছোট্ট এ জেলায় ৫টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা এবং ৫২টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। অথচ পুরো জেলায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার বা তারও বেশি। ফলে শহর থেকে গ্রামের সড়কেও ঘটছে বিড়ম্বনা। সেই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক এ অটোরিকশা চার্জ দেওয়ার কারণে বাড়তি চাপ পড়ছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাতেও।
শেরপুর জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. মাইনউদ্দিন আহমদ ঢাকা পোস্টকে জানান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে প্রতি বছর প্রায় ০.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। গ্রামের আবাসিক সংযোগে সাধারণত মাসে ৭০ থেকে ৮০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। কিন্তু একই সংযোগে যখন অটোরিকশা চার্জ দেওয়া হয় তখন মাসে ৩০০ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ হয়। এতে নির্দিষ্ট এলাকায় থাকা ট্রান্সমিটারগুলোর ওপর ভয়াবহ চাপ পড়ে। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
শেরপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মিজানুর রহমান ভূঁঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা ও সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের কাজ চলছে। দুর্ঘটনা কমাতে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। পৌর এলাকায় অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে পৌরসভার ভূমিকা বেশি। তবে জেলা পুলিশ সব সময় তৎপর আছে।
অটোরিকশার ডিলাররা জানান, বাজারে আসার শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০১২ থেকে ১৩ সালের দিকে একটি অটোরিকশার দাম ছিল ৯০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে প্রতি অটোর বাজার মূল্য প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা।
অটোরিকশা চার্জে বিদ্যুতের ওপর চাপ বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে ময়মনসিংহ পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈধ চার্জে সরকারের বিদ্যুৎ বিক্রি হয়। কিন্তু দিন দিন অটোর সংখ্যা বাড়তে থাকায় চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আমরা নিয়মিত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জেল-জরিমান করছি।