ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। লোকসান ও নানা সংকট কাটিয়ে নতুন মালিকানায় ‘রেপটাইলস ফার্ম’ এখন রপ্তানির প্রস্তুতির পাশাপাশি পর্যটকদের জন্যও উন্মুক্ত। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী এখানে এসে কাছ থেকে দেখছেন হাজারো কুমির ও তাদের বাচ্চা।
খামার সূত্র জানা যায়, আর্থিক সংকট ও মালিকানা জটিলতার কারণে ২০২০-২১ সালে ভালুকার কুমির খামারে প্রায় এক হাজার কুমির মারা যায়। চরম অচলাবস্থার মধ্যে খামারের কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য সংকটে পড়ে অবশিষ্ট কুমিরও ঝুঁকির মুখে পড়ে। ২০১৯ সালে মালিক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের অর্থ কেলেঙ্কারি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের পর থেকে কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খামারটি জাপানে ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া রপ্তানি করে সাড়ে ৭ কোটি টাকা আয় করেছিল, যা দেশে কুমির চাষের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু মালিকানা ও আর্থিক সংকটের ধাক্কায় সে গতি থেমে যায়।
অবশেষে আদালতের নির্দেশে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ‘উদ্দীপন’ নামে একটি এনজিও খামারটির মালিকানা গ্রহণ করে। নতুন ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করে রপ্তানিমুখী কার্যক্রম। বর্তমানে খামারটি শুধু কুমির চাষ ও রপ্তানি নয়, পর্যটন খাত থেকেও আয় করছে এবং আবারও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৪ একর জমির ওপর মেজবাহ উল হক ও মোস্তাক আহমেদ নামে দুই ব্যবসায়ী খামারটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিআইইএস’র ছাড়পত্র পেয়ে মালয়েশিয়া থেকে ৭৫টি কুমির আমদানি করে খামারটি। ২০১০ সালে প্রথম দফায় ৬৭টি হিমায়িত কুমির জার্মানিতে রপ্তানি করে খামারটি আয় করে দেড় কোটি টাকা। ২০১২ সালে আর্থিক প্রয়োজনে খামারের মালিকানা হস্তান্তর করেন বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে। এরপর থেকে খামার দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নেন পিকে হালদার। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া জাপানে রপ্তানি করে আয় হয় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে অর্থ কেলেঙ্কারিতে পিকে হালদার জড়িয়ে পড়ায় এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করায় খামারটিতে অচলাবস্থা দেখা দেয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধসহ চরম অব্যবস্থাপনায় কুমিরের খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আর্থিক সংকট ও মালিকানা জটিলতায় ২০২০-২১ সালে প্রায় এক হাজার কুমির মারা যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত খামারটি পরিচালনার জন্য সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. নাইম আহমেদকে চেয়ারম্যান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুমির বিশেষজ্ঞ এনামুল হককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আরও চারজনকে পরিচালক করে ৬ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন। এ বোর্ড ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি খামারের কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এনজিও ‘উদ্দীপন’ খামারটি কিনে নেওয়ার পর থেকে খামরটিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। খামারটি পরিচালনায় ম্যানেজারসহ ১২ জন কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন। খামারে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কুমির রয়েছে। কুমিরের খাবারের জন্য ফার্মের নিজস্ব ব্রয়লার মুরগির খামার, মাছের পুকুর, ডিম ফুটানোর জন্য অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর, কুমিরের বাচ্চার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হ্যাচারি, পৃথক শেড, চামড়া প্রসেসিং জোন ও ব্রিডার পুকুর রয়েছে।
খামার কর্তৃপক্ষ জানান, প্রথম দিকে আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সাতটি ব্রিডার কুমির মারা যায়। এসব কুমিরদের বাঁচিয়ে রাখা, ডিম পাড়ানো, ডিম সংরক্ষণ সেটি থেকে বাচ্চা ফুটানোসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। তবে অল্পদিনের মধ্যে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠে। বর্তমানে খামারে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কুমির রয়েছে। কুমিরের খাবারের জন্য ফার্মের নিজস্ব ব্রয়লার মুরগির খামার, মাছের পুকুর, ডিম ফুটানোর জন্য অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর, কুমিরের বাচ্চার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হ্যাচারি, পৃথক শেড, চামড়া প্রসেসিং জোন, চামড়া মজুদ রাখার জন্য চিলিং রুম, ব্রিডার পুকুর রয়েছে। এখানে ৩৫টি পুকুর, সাতটি শেড ও ১০টি হ্যাচারিতে স্ত্রী-পুরুষ কুমির আলাদা করে রাখা হয়। বংশবৃদ্ধির সময় স্ত্রী কুমির প্রতিটি গড়ে ৫০-৬০টি ডিম দেয়। কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটাতে ৮০ থেকে ৮৫ দিন সময় লাগে। একজোড়া কুমিরের জন্য সাধারণত ৮০ বর্গ মিটার জায়গা লাগে। ইনকিউবেটরে সংরক্ষণের পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে আলাদা পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। ছোট কুমিরকে গরু ও মুরগি মাংসের কিমা এবং মুরগির মাথা দেওয়া হয়। ব্রিডারে কুমিরকে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেওয়া হয়। তিন বছর বয়সের কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা হয়। আগামীতে এ ফার্ম থেকে বছরে ১৫ কোটি টাকা রপ্তানি আয় সম্ভব হবে।
পর্যটকদের জন্য প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কুমিরের খামারটি উন্মুক্ত থাকে। টিকিটের প্রবেশ মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১৫০ টাকা, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১০০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় রয়েছে।
খামারে কুমির দেখতে আসেন আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত হোসেন হিরা। তিনি বলেন, ‘কুমিরের খামার কখনো দেখিনি। তাই বন্ধুকে নিয়ে এখানে দেখতে এসেছি। খামারে ঢুকতে চোখে পড়ে ইটের প্রাচীর ও নেট দিয়ে ঘেরা পুকুরগুলো। এগুলোর পাড়ে উঠে রোদ পোহাচ্ছে কুমিরের ঝাঁক। বড় কুমিরগুলো রোদে হা করে শুয়ে রয়েছে। আলাদা জায়গায় রয়েছে অসংখ্য বাচ্চা কুমির। এগুলো দেখে চোখ জুড়িয়েছে।
আরেকজন দর্শনার্থী বলেন, ময়মনসিংহে বেসরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করি। স্ত্রীকে নিয়ে কুমির দেখতে আসি। অসংখ্য কুমির একসঙ্গে দেখে ভালো লেগেছে। কুমির খামারটি লাভের মুখ দেখে সচল থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। এ কুমির খামারের কর্তৃপক্ষ লাভবান হলে অন্যরাও কুমির খামার করতে উৎসাহ পাবে।
রেপটাইলস ফার্মের ম্যানেজার ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি খামারটি উন্মুক্ত করার পর থেকে ধীরে ধীরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসছেন। দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সী দর্শনার্থীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে খামারে এসে আনন্দে সময় কাটাচ্ছেন। টিকিটের মাধ্যমে আয় খামারের বাড়ছে। পর্যটকদের জন্য প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কুমিরের খামারটি উন্মুক্ত থাকে। টিকিটের প্রবেশ মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১৫০ টাকা, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১০০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় রয়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি কুমিরের চামড়া ৫০০-৬০০ ডলার মূল্যে রপ্তানি করা হয়। উপমহাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এ খামার থেকে কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা হলেও কুমিরের মাংস, হাড় ও মাথা রপ্তানির অনুমতি নেই। এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। একটি কুমিরের সবকিছু রপ্তানি করা গেলে আয় কয়েকগুণ বাড়বে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, ‘এক সময় প্রায় অচলাবস্থায় থাকা ভালুকার কুমির খামারটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশে কুমির চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে কুমির খামার করতে পারলে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করা সম্ভব। কেউ শর্ত মেনে আবেদন করলে পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেওয়া হবে।