বিদ্যমান আইন দিয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা। তাই তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা আইনটি বাতিল চেয়েছেন।
আবার সংবিধানের ৪৮ এর (৩) অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে ইসি গঠনের বিষয়টিও বাতিলের দাবি করেছেন কেউ কেউ। আর শুধু দায়মুক্তি নয়, যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইসিকে আইনের আওতায় আনার বিধান রাখার পক্ষে পরামর্শ এসেছে। শুরু থেকে ইসি নিয়োগের প্রত্যেকটি ধাপ সম্পর্কে বা কাদের নাম এসেছে, তাদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে পলিসি ডায়ালগে বক্তারা এসব মত দেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যত ভালো কমিশন গঠন হোক, ভালো নির্বাচন করতে হলে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজন। এ বিষয়ে তিনি তিন স্তরের একটা সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশকে মানবিক না করে দানব বানানো হয়েছে। তাদের হাতে ৭.৬২ এমএম রাইফেল দেওয়া হয়েছে। এটা তদন্ত করব বলেছি। কিন্তু এ নিয়ে আমাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। পুলিশের হাতে কারা দিয়েছে, সেটা তদন্ত করা দরকার। আমি তদন্ত করতে বলেছি, কেন দেওয়া হলো। উৎস জানি না, তা বলিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দায়মুক্তির বিধান যুক্ত করে ২০২২ সালে প্রণীত আইনে যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এর আগের নির্বাচন কমিশন পোস্ট অফিসের ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচন কমিশন পোস্ট অফিস নয়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
তিনি জানান, রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ইসি গঠনে তর কমিটি প্রস্তাব করবে।
নবীন প্রবীণের সমন্বয়ে আগামীর নির্বাচন কমিশন দেখতে চান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি ঐকমত্যে আছে। রাষ্ট্র সংস্কার একদিনে হয় না। এর জন্য সময় প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহকারী সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, সার্চ কমিটি ও ইসি গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নাম নিতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিচার বিভাগকে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন গঠনে যুক্ত করা উচিত হবে না। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সবার আগে প্রয়োজন বিদ্যমান আইনটি (ইসি নিয়োগ আইন) বাতিল করা। তিনি বলেন, এমনভাবে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া প্রণয়ন করতে হবে যাতে কোনো সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন তিনি।
গণ অধিকার পরিষদের (জিওপি) সভাপতি নুরুল হক নূর সাত শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি নিয়ে সাত সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর আশরাফ আলী আকন্দ কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে তাকে আইনের আওতায় আনার তাগিদ দেন।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যা পাঁচজন থেকে কমিয়ে তিনজন করার পক্ষে মত দেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, কমিশন গঠনে দল ছোট না বড় তা দিয়ে মতামত বিচার করা যাবে না।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক ড. আব্দুল আলিম উপস্থাপিত পলিসি ব্রিফে (নীতি প্রস্তাবনা) বলেন, যেকোনো নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু হয়। স্বাধীন কমিশন গঠনে তিনি এ সময় সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
প্রফেসর ড. রওনক জাহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন— ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ডানা এল. ওল্ডস। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন— প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ডেমোক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রেহমান, ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, খান ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী রোকসানা খন্দকার, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া, নাহিদা সারোয়ার চৌধুরী প্রমুখ।