দুইশো বছরের স্বাদে বাঁধা ঐতিহ্য মুক্তাগাছার মন্ডা ।।

17

ময়মনসিংহের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় এক নাম—মুক্তাগাছার মণ্ডা। প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদারি আমলে এক দরবেশ সন্ন্যাসীর হাতে যাত্রা শুরু এই মিষ্টান্নটির। সময়ের বাঁকে বাঁকে আজ তা হয়ে উঠেছে শুধু একটি খাবার নয়, বরং এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মুক্তাগাছার তৎকালীন জমিদার শ্রী শ্রী শশিকান্ত মহারাজ রাজকীয় আতিথেয়তায় অতিথিদের মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। দেশি-বিদেশি জমিদার, রাজা-বাদশাদের জন্য ছিল এই মিষ্টি এক বিশেষ আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতা টপকে মণ্ডা আজও জাগ্রত রেখেছে তার গৌরবময় অবস্থান।

মিষ্টান্নটির সূচনা হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার তারাটী গ্রামের গোপাল পাল নামক এক কারিগরের হাতে। ১৮২৪ সালে তৈরি করা এই মণ্ডা প্রথম পেশ করা হয় জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর দরবারে। সময়ের পরিক্রমায় এখন গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর রামেন্দ্রনাথ পাল ও তার ভ্রাতৃদ্বয় বহন করে চলেছেন এই ঐতিহ্য।

দুধের ছানা আর চিনিই এই মিষ্টির প্রধান উপাদান। তবে শীতকালে বিশেষ সংস্করণ হিসেবে তৈরি হয় গুড়ের মণ্ডা, যা স্বাদে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এর প্রস্তুতপ্রণালিতে আজও ব্যবহার হচ্ছে পুরোনো কারিগরদের শেখানো পদ্ধতি, যা কেবল মিষ্টির স্বাদই নয়—ধরে রেখেছে ঐতিহ্যও।

২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুক্তাগাছার মণ্ডা বাংলাদেশের ২৬তম জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের স্বীকৃতি লাভ করে। এই স্বীকৃতি শুধু একটি মিষ্টির জন্য নয়, বরং শতবর্ষীয় ঐতিহ্য রক্ষার এক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

বর্তমানে মণ্ডা পাওয়া যায় মুক্তাগাছা শহরের চৌরঙ্গি মোড় এলাকার ঐতিহ্যবাহী দোকানে। প্রতিটি মণ্ডা বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়, আর প্রতি কেজি ৭০০ টাকা। শাখা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোজনরসিকরা ভিড় করেন এই দোকানে।

পঞ্চম বংশধরের এক ছেলে রামেন্দ্রনাথ পাল জানান, “আমাদের মণ্ডার কোনো শাখা নেই। তবু দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন আসল মণ্ডার স্বাদ নিতে। শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এর সুখ্যাতি।”

পঞ্চম বংশধরের আরেক ছেলে মিথুন পাল বলেন, “আমরা পুরনো ঐতিহ্য ও মান ধরে রাখার জন্য আগের কারিগরদের থেকে শিখে এখনো সেই রীতিতেই মণ্ডা তৈরি করছি। আমাদের মণ্ডা শুধু মিষ্টি নয়—এটি ইতিহাস, এটি সংস্কৃতি, এটি আমাদের পরিচয়।”

মুক্তাগাছার মণ্ডা তাই শুধু একটি খাবারের নাম নয়, বরং দুইশো বছর ধরে টিকে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস—যা আজও একই স্বাদে মুখর করে রাখে ভোজনরসিকদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here