ময়মনসিংহে একটি পুরোনো স্থাপত্য ভেঙে ফেলা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়, সেটি উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল। ফলে এ স্থাপনা ভাঙা নিয়ে ভারত সরকারও উদ্বেগ দেখায় এবং বিবৃতি দেয়। তখন এ ঘটনা নিয়ে আরও বেশি আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, এ বাড়িটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের ছিল না। বরং সে বাড়ি অন্যটি। তাহলে এ বাড়িটি কাদের? আসলেই কি স্থাপনাটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের ছিল, নাকি ছিল না? ইতিহাসেই লুকিয়ে আছে এ বিতর্কের সমাধান। আসুন, দেখি ইতিহাস কী বলে।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির কালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদারির মোট সংখ্যা ছিল ৫০। এর মধ্যে টাঙ্গাইলে ১৫, কিশোরগঞ্জে ১৪, ময়মনসিংহে ৭, জামালপুরে ১, নেত্রকোনায় ৭ ও শেরপুরে ৬টি। মসূয়া জমিদারবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায়।
বাংলার শিশুসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ লেখক, সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। তাঁর পুত্র ছন্দের জাদুকর সুকুমার রায় এবং পৌত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের আদি নিবাস ছিল এই মসূয়া।
যদিও সুকুমার রায় অথবা সত্যজিৎ রায় তাঁদের কারোরই অতখানি সম্পর্ক ছিল না ময়মনসিংহের সঙ্গে। তবে উপেন্দ্রকিশোর রায় বেড়ে উঠেছিলেন এখানেই। প্রবল টানও ছিল তাঁর। নিজেকে তিনি পরিচয় দিতেন ‘ময়মনসিংহী বাঙাল’ হিসেবে।
উপেন্দ্রকিশোর রায় ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পেয়েছিলেন ১৫ টাকা বৃত্তি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান কলকাতায়। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বিএ পাস করেন। তাঁরই সঙ্গে একই স্কুলে পড়তেন লেখক ও সম্পাদক গগনচন্দ্র হোম। কলকাতায় গিয়ে তাঁদের রিশতা আরও বাড়ে। ‘ব্রহ্মজ্ঞানী’ বলে যে গগনচন্দ্রকে টিপ্পনী কাটতেন, সেই তাঁরই প্রভাবে উপেন্দ্রকিশোর গ্রহণ করেন ব্রাহ্মধর্ম। আত্মজীবনীতে গগনচন্দ্র লিখেছেন ‘ময়মনসিংহে থাকিতে উপেন্দ্রকিশোরের ব্রাহ্মসমাজে আসা হয় নাই—কলকাতা আসিয়া তিনি আর আমাদের ছাড়িয়া থাকিতে পারেন নাই।’
তাঁর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ পিতা হরিকিশোরকে আহত করে। হরিকিশোর মারা গেলে উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মধর্ম মতে শ্রাদ্ধকার্য করেন। অবশ্য হরিকিশোরের অপর পুত্র নরেন্দ্রকিশোর হিন্দু প্রথামতেই শ্রাদ্ধ করেন। এতে উপেন্দ্রকিশোরের প্রতি তাঁর আত্মীয়স্বজন ক্ষুব্ধ হয়। সে কথা তাঁর পুত্র সুকুমারের লেখাতেও উঠে এসেছে। পিতার মৃত্যুর কিছুকাল পরই উপেন্দ্রকিশোর মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীকে। একে ধর্মত্যাগ, আবার জাত ছেড়ে বিবাহ! অনুমান করা দুরূহ নয় উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে ময়মনসিংহে থাকা পরিবারের অনেকের সঙ্গেই দূরত্ব আরও বাড়ে।
উপেন্দ্রকিশোরের জীবন কলকাতানির্ভর হয়ে ওঠে। জমিদারি কার্য দেখতে তিনি মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহ আসতেন, এই এতটুকুই। জমিদারির ভাগাভাগিতে ময়মনসিংহের বাড়ি ও মসূয়ার জমিদারির বেশির ভাগই পেয়েছিলেন নরেন্দ্রকিশোর। বিয়ের পর উপেন্দ্রকিশোর ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের লাহাবাড়িতে বসবাস আরম্ভ করেন। শিবনারায়ণ দাস লেন থেকে পরে সুকিয়া স্ট্রিটে জীবনভর ভাড়া বাড়ি। মৃত্যুর কিছুকাল আগে নিজের বাড়ি করেন ১০০ নং গড়পার রোডে। তখন বিশ্বযুদ্ধ, ওষুধের আমদানি বন্ধ, বহুমূত্র রোগে একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান উপেন্দ্রকিশোর।
উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর পুত্র সুকুমার রায় জমিদারির কাজ দেখতে সর্বশেষ ময়মনসিংহ আসেন ১৯২০ সালে, এসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। তিনি যখন অসুস্থ তখন ১৯২১ সালে জন্ম হয় সত্যজিতের। পুত্রের জন্মের দুই বছর পর মারা যান সুকুমার রায়। লাখখানেক টাকার দেনায় জমিদারি আর বাড়ি দুই-ই বিকোতে হয় তাঁদের। কিন্তু মসূয়ায় থাকা জমিদার নরেন্দ্রকিশোর ভাইয়ের পরিবারের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই করেননি।
উপেন্দ্রকিশোরের মূল যে ভিটা, সেই মসূয়ার জমিদারবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। যদিও সেই জমিদারবাড়ির সংস্কার ও সংরক্ষণেও যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। হরিকিশোর রায় রোডের শিশু একাডেমির পরিত্যক্ত বাড়ি ভাঙা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইহীন যে মন্তব্য করেছে, তা অসত্য এবং দুর্ভাগ্যজনক।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য সচিব এবং রায় পরিবারেরই সন্তান প্রসাদরঞ্জন রায় ‘ময়মনসিংহ ও উপেন্দ্রকিশোর’ শিরোনামে কালি ও কলমে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন:
‘উপেন্দ্রকিশোর ১৮৯৮ সালে ভূমিকম্প ও প্লেগের মহামারির পর একবার, ১৯০৫-০৬ সালে সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে একবার, ১৯১১ সালের শেষে একবার আর সম্ভবত সুকুমারের বিবাহের পর একবার দেশে গিয়েছিলেন। দেশের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে আসছিল।’
শুধু উপেন্দ্রকিশোরের নয়, তাঁর পরিবারের আর কারও সঙ্গেই মসূয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আর বহাল থাকেনি। তিনি আরও লিখেছেন: ‘১৯২৬ সালেই গড়পারের বাড়ির সঙ্গে এবং মসূয়ার জমিদারির সঙ্গে সম্পর্কের শেষ…যদিও হরিকিশোরের বংশধরদের কেউ কেউ বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন মসূয়ায়। তবে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের বংশধরদের সঙ্গে মসূয়ার সম্পর্ক সেই শেষ।’
উপেন্দ্রকিশোর জমিদার হরিকিশোর রায়ের ঔরসজাত সন্তান ছিলেন না। হরিকিশোর প্রবল সম্পত্তির মালিক ছিলেন বটে, ওকালতির টাকায় জমিদারিও কিনেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অপুত্রক। পুত্র লাভের আশায় তিন বিয়ে করেন তিনি। শেষতক জ্ঞাতি ভাই কালীনাথ রায়ের সন্তান কামদারঞ্জনকে দত্তক নেন। নতুন করে নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। অবশ্য দত্তকের দুই বছর পর তাঁর নিজের পুত্র নরেন্দ্রকিশোরের জন্ম হয়।
আদতে এই বংশের মানুষের আদি নিবাস মসূয়ায় ছিল না। তাঁদের কৌলিক পদবিও রায় নয়। তাঁরা নদীয়া থেকে ঈসা খাঁর শাসনামলে আসেন শেরপুর। ছিলেন জমিদারির কর্মচারী। শেরপুর থেকে কিশোরগঞ্জের যশোদল আর সেখান থেকে মসূয়ায় বসতি গড়েন। ইংরেজ আমলে জমিদারির মালিক হন। কোর্ট-কাচারির প্রয়োজনে ময়মনসিংহ শহরে কাছাড়িবাড়ি করেন।
সেই বাড়ির কথাও প্রসাদরঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন। ওই বাড়ি দ্বিতল ছিল, বাড়ির সামনে ছিল অনেকটা মাঠের মতো খোলা জায়গা। বাড়িটি ময়মনসিংহ শহরের হরিকিশোর রায় রোডে ছিল। শাহি মসজিদের পাশে পূর্ব পাশে এই বাড়ির স্থানে বর্তমানে ‘দুর্লভ ভবন’ নামে একটি বহুতল ভবন রয়েছে। বাড়িটির আদি নাম ছিল ছিল পুণ্যলক্ষ্মী ভবন।
সেই সুকুমারের মৃত্যু, তারপর আর উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের কেউ মসূয়ায় কিংবা ময়মনসিংহে পা রাখেনি।
ভাওয়াল জমিদারবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড থেকে আনা জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। ময়মনসিংহ শহরে প্রথম ডিসি জেনারেটরের মাধ্যমে টাঙ্গাইলের দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তাঁর কেনা তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ছিল ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহে তাঁর যে বাড়ি ছিল, পরে সেই বাড়ি শিশু একাডেমির ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাড়িটি হরিকিশোর রায় রোডে অবস্থিত।
২০০৭ সালের পর থেকে ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। তা ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর দেশ-বিদেশে বাড়িটিকে সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোরের বাড়ি বলে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, যা মোটেই সঠিক নয়। ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, ময়মনসিংহ’-এ ৩৫৭ পৃষ্ঠায় বাড়িটি আরপি সাহার বাড়ি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিবিজড়িত শহরের সেই বাড়ি ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি। দেশভাগের সময়ে দুর্লভ খানের পুত্র প্রখ্যাত পাট ব্যবসায়ী এম আর খান বাড়িটি সাফকবলা দলিল মূলে কিনে রাখেন।
তবে উপেন্দ্রকিশোরের মূল যে ভিটা, সেই মসূয়ার জমিদারবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। যদিও সেই জমিদারবাড়ির সংস্কার ও সংরক্ষণেও যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। হরিকিশোর রায় রোডের শিশু একাডেমির পরিত্যক্ত বাড়ি ভাঙা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইহীন যে মন্তব্য করেছে, তা অসত্য এবং দুর্ভাগ্যজনক।
অবশ্য ইতিহাস সংরক্ষণের অংশ হিসেবে সরকারের উচিত প্রতিটি শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো সংস্কারের মাধ্যমে কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া।