বাকৃবি গবেষকদলের পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবন

9

বাকৃবি প্রতিনিধি : বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও বালাইনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপদে পড়েছে। বিষাক্ত এসব বালাইনাশক মানব স্বাস্থ্য, মাটি, পানি ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। দেশে বালাইনাশকের মধ্যে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার সর্বাধিক ৪৫-৪৬ শতাংশ, এরপর কীটনাশক ৩৩ শতাংশ এবং আগাছানাশক ২০-২১ শতাংশ। এগুলোর বেশির ভাগই মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই সমস্যা সমাধানে দেশে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ও অনুজীব দিয়ে ফসলের উৎপাদন বর্ধক ও পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

বাকৃবির উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিলের নেতৃত্বে গবেষক দলটি ট্রাইকোডার্মা এসপেরেলাম নামক ছত্রাক ব্যবহার করে একটি নতুন ছত্রাকনাশক উদ্ভাবন করেছেন যার নাম পি.জি. ট্রাইকোডার্মা। অধ্যাপক মঞ্জিল ছত্রাকটি আইসোলেট ও বায়োফর্মুলেশন উন্নয়ন করেন। গবেষক দলের অন্য দুই গবেষক- কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কে. এম. মহিউদ্দিন এর গুণগত মান ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেন এবং ফার্ম স্ট্রাকচার ও এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ উৎপাদন ও পরিবেশগত মূল্যায়ন পরিচালনা করেন। গবেষণাটি বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি ও বায়োকন্ট্রোল ল্যাবে সম্পন্ন হয়।

গবেষকবৃন্দ বলেন, এই উদ্যোগটি ২০০১ সাল থেকে শুরু হয়। তখন থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছোট ছোট অনুদানের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। গত বছর বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) এর মাধ্যমে এই প্রযুক্তির প্রসার ও প্রচারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে এবং বাণিজ্যিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহৃত হওয়ায় এটি সহজলভ্য ও কম মূল্যে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। পর্যাপ্ত গবেষণা বরাদ্দ পেলে ভবিষ্যতে আমাদের বায়ো-ইনসেক্টিসাইড এবং বহুমুখী কার্যক্ষমতা সম্পন্ন জৈব বালাইনাশক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে।

পরিবেশবান্ধব এই ছত্রাকনাশক সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ছত্রাকনাশকটির মূল উপাদান ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলাম যা আমাদের দেশের মাটি থেকে গবেষণার মাধ্যমে শনাক্ত ও আলাদা করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা এবং বাংলাদেশের জলবায়ুতে অনুজীবটি ভালোভাবে অভিযোজিত। গবেষণার শুরুতে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার মাটি ও রাইজোস্ফিয়ারের (শিকড়ঘেঁষা) মাটির নমুনা সংগ্রহ করে শতাধিক ট্রাইকোডার্মা ছত্রাক পৃথক করা হয়েছে। ট্রাইকোডার্মার শতাধিক প্রজাতি থাকলেও আমরা ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলাম বেছে নিয়েছি কারণ এটি আমাদের দেশের পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে অভিযোজিত এবং অধিক কার্যকর। এছাড়া দেশীয় অণুজীব থেকে এই ছত্রাকনাশকটির উন্নয়ন করা হয়েছে বিধায় বাজারে প্রাপ্ত অন্যান্য আমদানিকৃত ট্রাইকোডার্মার চেয়ে এটি বেশি কার্যকর।

ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলাম সম্পর্কে অধ্যাপক শাহজাহান মঞ্জিল আরও বলেন, ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একযোগে ছত্রাকনাশক এবং জৈব সার হিসেবে কাজ করে। এটি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জৈব ছত্রাকনাশক যা এনজাইম, উদ্বায়ী যৌগ ও সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটসহ বিভিন্ন জৈব উপাদান উৎপাদনে সক্ষম। এই উপাদানগুলো উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়, শিকড়ে বসবাস করে পুষ্টি গ্রহণ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং তাপ, অম্লতা ও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। আমাদের এই গবেষক দলই দেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলাম প্রজাতির জিন সিকুয়েন্সিং করতে সক্ষম হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও তা নথিভুক্ত হয়েছে। ঘঈইও এবহব ইধহশ-এ এটি সংরক্ষণ করা হয়েছে (এর একসেশন নম্বর: ঙজ১২৫৬২৩)।

পি.জি. ট্রাইকোডার্মা ব্যবহারে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পর্কে অধ্যাপক শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ছত্রাকনাশকটির প্রয়োগে আমরা ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন ফসলের উল্লেখযোগ্য ফলন বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছি। টমেটো, আলু ও বেগুনে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ, পালং ও পুঁইশাকে ফলন বেড়েছে ৪০-৫০শতাংশ, পানে ফলন বেড়েছে প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ, চা গাছে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০-১০০ শতাংশ, ঢেঁড়স, মরিচ ও শসায় ফলন বেড়েছে ১৫-২০ শতাংশ। ডাল, ধান ও ফলগাছে রোগ দমন ও গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকায় ফলন স্থিতিশীল বা ধীরে ধীরে বৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে। অধ্যাপক মঞ্জিল আরও বলেন, পি.জি.ট্রাইকোডার্মা গোড়াপচা, কান্ডপচা, পাতাপচা ও ব্লাইট দমনে কার্যকর, শিকড়ের বৃদ্ধি ও পুষ্টি গ্রহণ বাড়িয়ে ফসলের উৎপাদন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এটি ছাদ কৃষি ও মৎস্য চাষেও উপযোগী যা কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক।

অধ্যাপক মহিউদ্দিন বলেন, ছত্রাকনাশকটি জৈব সার হিসেবেও কাজ করার কারণে মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সার প্রায় ২০-২৫ শতাংশ কম ব্যবহার করেও প্রায় একই বা বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব হয়েছে। জৈব সার হিসেবে এটি ফসফেট দ্রাব্যকরণ করে, নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ায়, মাটির অম্লতা ও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করে। শিশা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতু সম্বলিত দূষিত মাটিতে নিরাপদ ফসল উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণায় ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে এটি টেকসই ও বিজ্ঞানসম্মত জৈবিক বিকল্প হতে পারে।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশকটি জলজ পরিবেশের জন্যও নিরাপদ। এটি কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান বহন করে না এবং প্রয়োগের পর পানিতে পড়ে গেলে মাছ, ব্যাঙ, শামুক বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। আমাদের গবেষণায়ও এ পর্যন্ত জলজ প্রাণীতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

এই বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বাকৃবির অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহযোগিতায় তেলাপিয়া মাছের ওপর একটি যৌথ গবেষণা পরিচালনা করেছি। এই গবেষণায় পি.জি. ট্রাইকোডার্মা-এর প্রয়োগ শুধুমাত্র জমির ফসল নয়, বরং জলজ পরিবেশ ও মাছের চাষেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফিড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে পি.জি. ট্রাইকোডার্মার প্রয়োগে মাছের ওজন ও আকার বৃদ্ধি, পানির গুণমান উন্নয়ন, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও প্যাথোজেনিক ছত্রাক কমেছে এবং দূষণ হ্রাস পেয়েছে। বড় পরিসরে ব্যবহারের আগে মাছ চাষের ধরন ও পুকুর পরিস্থিতি বিবেচনা জরুরি। আমাদের গবেষণা চলছে, আশা করি ভবিষ্যতে এটি টেকসই অ্যাকুয়াকালচারের সমাধান হতে পারে।

ইতোমধ্যে ছত্রাকনাশকটির বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে। ছত্রাকনাশকটির ব্যবহারকারীদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা এটির বাস্তবিক সুফলতা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন।

মৌলভীবাজারের ফুলতলা টি এস্টেটের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শিহাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি আমার চা বাগানে পিজি ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার করে পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ফলন পেয়েছি। আগে যেসব রাসায়নিক ছত্রাকনাশক ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ব্যবহার করতাম সেগুলোর ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছি। ট্রাইকোডার্মা একদিকে যেমন ছত্রাকনাশক হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে গাছের শুটিং বিহেভিয়ারও (নতুন কুঁড়ি আসার প্রবণতা) বাড়িয়ে দেয়। আমি সাধারণত প্রতি লিটারে ৩ গ্রাম ব্যবহার করি, তবে ৫ গ্রাম দিলে ফল আরও ভালো হয়। এছাড়া এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা।

নরসিংদীর পান চাষি কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম বলেন, পান চাষে গোড়া পচা মারাত্মক একটি রোগ। এর আক্রমণে গাছ মারা যায়। এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করতাম। তবে এই ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরে গাছ আর ওই রোগে মারা যায় নি বিধায় ব্যাপক লাভবান হয়েছি। প্রায় অর্ধেক খরচ সাশ্রয় করে ফলন অনেক বেড়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক ড. সালমা লাইজু বলেন, পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবিত হলে তা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ, গবাদিপশু সকলকিছুর জন্যই উপকারী হবে। এটি দেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা হতে পারে। যদি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিলের উদ্ভাবিত ছত্রাকনাশকটি সাশ্রয়ীমূল্যে পাওয়া গেলে আমাদের কৃষি অফিস থেকে সেটি কিনে সাধারণ কৃষকদের সাহায্য করতে পারবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here